তারেক আজিজ:
উচ্চশিক্ষার প্রথম পাঠ নেওয়ার জন্য মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। একটা সময় উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে ভর্তি হতে পারতো। সেক্ষেত্রে সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে যারা এগিয়ে থাকতো তারাই বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে। এখন সেরাদের সেরা হয়েই পা রাখতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখেনা এই প্রতিযোগীতায়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষাকে এখন ‘ভর্তি যুদ্ধ’ বলে অনেকেই। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে ভর্তিচ্ছুরা প্রস্তুতি নেয় ভর্তি যুদ্ধের জন্য।
মেধার এই লড়াইয়ে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য তারা বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখে। এই একেকটা স্বপ্নই একসময় অনেক বড় হয়ে যায়, এই স্বপ্নগুলোই একসময় একেকটা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়, এই স্বপ্নগুলোই একসময় দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। সবকিছুর শুরু কিন্তু ঐ স্বপ্ন থেকেই। তরুণ প্রাণের এই স্বপ্নের লালনকর্তা আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিকে মেধার বিচারে সবাই যেন সমান সুযোগ পায় এটা একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর ন্যায্য দাবী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় একই ইউনিটে বিভিন্ন শিফটে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরিক্ষা নেওয়া হয় এবং সবগুলো শিফট মিলে ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে দুটি অভিন্ন মেধা তালিকা তৈরি করা হয়। প্রশ্নের কাঠিন্যতা, সময় ও পরিবেশের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে চরম বিতর্ক আছে এই সিস্টেমের শুরু থেকেই। তবুও কোনো এক অজানা কারণে এই বৈষম্যপূর্ণ শিফট সিস্টেমের কোনো সুরাহা আজও হয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের ভর্তি পরিক্ষা শুরু হয়েছে ৯ নভেম্বর। শুরুর প্রথম দুইদিনে মোট ১০ টা শিফটে অনুষ্ঠিত হয় ‘ডি’ ইউনিটের পরিক্ষা। শুরু হয় আবারও সেই পুরোনো বিতর্ক। ভর্তি পরিক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩২০ টি আসনের বিপরীতে প্রথম শিফট থেকে ১০ জন, দ্বিতীয় থেকে ৭ জন, তৃতীয় থেকে ১ জন, চতুর্থ থেকে ১৮, পঞ্চম থেকে ১০৪ জন, ষষ্ঠ থেকে ২২ জন, সপ্তম থেকে ৫৩ জন, অষ্টম থেকে ২৯ জন, নবম থেকে ৪৯ জন এবং সর্বশেষ দশম শিফট থেকে ২৭ জন শিক্ষার্থী মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে।
অর্থ্যাৎ পঞ্চম শিফট থেকে সর্বোচ্চ ১০৪ জন ও তৃতীয় শিফট থেকে সর্বনিম্ন মাত্র ১ জন মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ যেন এক ভাগ্য পরিক্ষারই নামান্তর। পরেরদিন অনুষ্ঠিত ‘বি’ ইউনিটের ফলাফল বিশ্লেষণ করেও দেখা যায়, মোট পাঁচ শিফটে অনুষ্ঠিত পরিক্ষায় ৩২৬ টি আসনের বিপরীতে সর্বোচ্চ ২১৭ জন স্থান পেয়েছে পঞ্চম শিফট থেকে এবং দ্বিতীয় শিফট থেকে সর্বনিম্ন ১২ জন মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে। পরের দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত ‘জি’ ও ‘এইচ’ ইউনিটের ফলাফলেও একই রকম চিত্র ফুঁটে উঠেছে। যা স্পষ্টতই একটা বৈষম্য। শুধু তাই না, বিগত বছর গুলোর ফলাফল বিশ্লেষণেও একই রকম বৈষম্যমূলক চিত্র উঠে এসেছে।
এমন বৈষম্যমূলক চিত্র তুলে ধরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আগামী বছরে এই সমস্যা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায় তা নিয়ে ভাববেন বলে জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো বিগত বছরগুলোতেও এমন আশ্বাস দিলেও কেন সুরাহা হয়না এমন বৈষম্যমূলক পরিক্ষা পদ্ধতির? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ক্ষুদ্ধ এক ভর্তিচ্ছু লিখেছেন, জাহাঙ্গীরনগরে লটারির টিকেটে নাম ওঠেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সমন্বিত ভর্তি পরিক্ষা ভালো করেছেন কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকা তো দূরের কথা, ওয়েটিং লিস্টেও তার নাম নেই। এদিকে ক্যাম্পাসে তো একটা কথা চাওর হচ্ছে, আজ কোন শিফটের বাজিমাত হলো?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ১০ টা অথবা ৫ টা শিফটের পরিক্ষায় একই কাঠিন্যতা বজায় রেখে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা সম্ভব। তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায়টা কি? সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে কেন্দ্র সংখ্যা বাড়িয়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরিক্ষা নেওয়া।
প্রসঙ্গত, আমরা যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিফট পদ্ধতির দিকে নজর দেই, সেখানে প্রতিটা শিফটের জন্য আলাদা মেধাতালিকা তৈরী করা হয় এবং ওয়েটিং লিস্ট থেকেও একই অনুপাতে আসন সংখ্যার বিপরীতে ভর্তি নেওয়া হয়। এটা হতে পারে মন্দের ভালো। তবে অবস্থা যাইহোক কোনোভাবেই শিফট সিস্টেমে আস্থা রাখতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।
এজন্য শিক্ষকদের আর্থিক লোলুপতাকেই এগিয়ে রাখছেন অনেকে। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে এই ত্রুটিপূর্ণ ভর্তি পরিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন নাহলে অসন্তোষ আরোও বাড়বে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে লাখো তরুণের স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করে যুগোপযোগী ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে ভর্তি পরিক্ষা গ্রহণ করার।
লেখক- শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
নিউজ গার্ডিয়ান/ এমএ/