সাদিকুর রহমান:
অত্যন্ত আলোচিত-সমালোচিত মহান এক দার্শনিক জার্মানির প্রুশিয়ার রক্কেনে ১৮৪৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। আধুনিক যুগের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য আর ঈশ্বরকে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলা কিংবা নারীদের বিপদজনক খেলনার পুতুল (But what is woman for? A dangerous toy) বলে যিনি তাঁর আচরণে রুঢ়তার প্রকাশ করেছিলেন সেই ব্যক্তিটিই পৃথিবীতে অতিমানবের জন্ম হোক এবং তারা এই পৃথিবীকে চাষাবাদ করুক সেই আশা ব্যক্ত করেছিলেন। এক সময় যাকে ধার্মিকতার জন্য মঠবাসী খ্রিস্টান বলে টীকাটিপ্পনী শুনতে হয়েছিল সেই ধার্মিক ব্যক্তিটি যে কিনা ঈশ্বরকে বলে বসেন ঈশ্বর মৃত! ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে! অতিমানবেরা এখন দখল করবে তার স্থান। তাঁর এই অতিমানবের যাত্রা যেমন তাঁর ইচ্ছা তত্ত্বের আলোচনায় ‘মানুষ হওয়া আর ক্ষমতার প্রতি দুর্বল হওয়া একই কথা’ এর মাঝে খুঁজে পাই তেমনি আবার এই অতিমানব কে ‘Blue Blood বা অভিজাত’ ও জন্মগত বলেও মন্তব্য করতে দেখি। তাঁর অতিমানবের তত্ত্ব যা বিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রশংসিত। এমনকি যারা তাকে নাস্তিক বলে অপছন্দ বা গালি পর্যন্ত দেয় তারাও তাঁর এই সুপারম্যান বা অতিমানব তত্ত্বকে ভালোবাসছেন। এবার তাহলে প্রশ্ন আসে তাঁর এই অতিমানবেরা কেমন হবেন? তারা দৈহিকভাবে বিশাল আকার দেহবিশিষ্ট হবেন নাকি অতিপ্রাকৃতিক কোন কিছু? কিংবা তা আদৌ কোনো বস্তু জগতে সম্ভব কিনা কিংবা সে জন্মালে কি হবে তার কাজ? ইত্যাদি যত প্রশ্নই আসুক না কেন সব প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে পাব তাঁর এই অতিমানব তত্ত্বীয় আলোচনায়।
নীটশের অতিমানব ঐশ্বরিক কোন সত্ত্বা কিংবা কোন ফেরেশতা নন। যে তার পাখা থাকবে। সব কাজ মুহুর্তের মাঝে অলৌকিক ক্ষমতায় করে ফেলবে। বরং তিনি এসব অলৌকিক ক্ষমতা বা শক্তি কে অলীক বলে মনে করতেন। এগুলি আজগুবি রসাত্মক ও কৌতূহল উদ্দীপক গল্প। যা কেবল ধর্মের হীন আস্তাবলেই পাওয়া যায়। বাস্তবে এরকম কখনো সম্ভব নয়। বরং আমাদের এই অতিমানব হবে রক্ত মাংসের মানুষ। যে বুদ্ধিদীপ্ত আর ব্যক্তিত্বগুণে হবে অনন্য। আর এরকম অতিমানব দেহের কথাই সম্ভবত ডাক্তার লুৎফর রহমান তার ‘উন্নত জীবন’, ‘সংগঠন ও বাঙালি’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদরা লিখতে চেষ্টা করেছেন কিংবা সেই আকাঙ্ক্ষাকে ঝংকার মাহবুব গল্পের চ্ছলে শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছিলেন- ‘প্যারাময় লাইফের প্যারাসিটামল’ এবং ‘রিচার্জ Your ডাউন ব্যাটারি’ নামক বইয়ের মাধ্যমে।
এই অতিমানবরা হবেন সুলতান বায়েজিদের মত ইলদিরিম বা বজ্রপাত। যারা সাহস আর শৌর্যবীর্যে হবেন পৃথিবীর সেরা ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, ধৈর্যশীল এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারা এক সুকঠিন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। অতিমানব সর্বদা সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হবেন। ক্ষমতা লাভের অদম্য ইচ্ছা দ্বারা চালিত হয়ে সে হয়ে উঠবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। সব রকমের প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সে করবে পদদলিত। এজন্য তিনি নেপোলিয়নের মত ব্যক্তিকে বেচে নেন এবং বলেছিলেন –
‘It is to Napoleon that the honor shall one day be given of having made for a time a world in which the man the warrior, outweighed the tradesmen and the philistine’
নীটশের এই অতিমানব হবে এক বীর যোদ্ধা। যে মানবে না কোন বাধা, কোনো প্রতিবন্ধকতা। যে সকল ডর-ভয় কে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবে আপন গন্তব্যে। এক্ষেত্রে বাধা-প্রতিবন্ধকতা তাকে মোটেই পেছাতে পারবে না। যেমনটি আমরা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতায় পাই-
‘আমি চিরদূর্দম, দূর্বিনীত নৃশংস
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ আমি সাইক্লোন আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার’।
অর্থাৎ সে কোন কিছুতেই কাউকে পরোয়া করে না। আর সেজন্য নীটশে একে বৃহৎ ভয়ঙ্কর পশু (Big Bond Beast) বলে অবহিত করেছেন। যে সব ধরনের বাধা ডিঙিয়ে সুখকে অবলীলায় উপেক্ষা করে প্রবর্তন করে স্বীয় নিয়ম-আইন-কানুন। আর তাতে মনে হয় যেন নজরুল নীটশে থেকেই নিজেকে প্রজ্বলিত করেছিলেন।
এই অতিমানব মানে না কোন প্রকার পূর্বসংস্কার বরং সে সব মতাদর্শকে উপেক্ষা করে প্রবর্তন করে স্বীয় আইন। কবি আল মাহমুদের ভাষায়-
‘অক্ষ উজ্জ্বলতা অলৌকিক স্পর্শের অতীত
ওই তো মহান তিনি নিরুপম পরম সুন্দর’
নীটশের এই অতিমানব হবে একজন উৎকৃষ্ট স্বৈরাচার। সার্বজনীন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র তার কাছে মূল্যহীন। তার ইচ্ছেই হবে আইন। তার চাওয়াই হবে সকলের চাওয়া। যেন বর্তমান সময়ের কিম জং উন। যে কিনা একাই আমেরিকার মত দেশ কে ভাবিয়ে তুলতে পারে এক পারমাণবিক পরীক্ষায়।
আর নীটশের সাথে মুখ মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদও বোধহয় তাই লিখে ফেলেছিলেন-
‘যতবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠাক-
ঠিক করি জুতো হব স্বৈরাচারী- চেঙ্গিস বা অন্য কোনো- একনায়কের।
তার পায়ে সেঁটে থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠবো উপরে,
বলবো, ‘স্বৈরতন্ত্র ছাড়া মানুষ আর সভ্যতার কোন বর্তমান-ভবিষ্যত নেই’।
বলবো, ‘চিরকাল অস্ত্রই ঈশ্বর’।
প্রতিক্রিয়াশীল হবো হাড়েহাড়ে, হৃদপিণ্ড বেজে যাবে,
‘আমি প্রতিক্রিয়াশীল। আমি প্রতিক্রিয়াশীল’।
নীটশের এই অতিমানব জন্মাবেই কেবল শাসন করার জন্য। তার রক্তই হবে উন্নত জাতের রক্ত। সে প্রকৃতিগতভাবেই হবে প্রভু। এজন্যই বোধহয় অভিজাততন্ত্রের প্রতি সারা জীবন নীটশের দুর্বলতা ছিল। এক্ষেত্রে আমরা আধুনিককালে কয়েকজন ব্যক্তি কে বলতে পারি যারা এরকম ছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, বারাক ওবামা, লি কুয়ান ইউ, মাহাথির মোহাম্মদ, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান সহ আরও অনেকে। এই অতিমানবরা চটুল প্রশংসায় কখনো খুশি হন না বরং তাদের কাছে এগুলো অর্থহীন। তারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে পারে এমন পরাজিত বীরদেরকে সাহসের সাথে কথা বলতে পারায় পুনরায় তাদেরকে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতেও দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবার আগে আলেকজেন্ডার এর নামই আমাদের চোখে পড়ে। যিনি ভারতবর্ষে এসে ঠিক এরকমটাই করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নিটশের নিম্নোক্ত মন্তব্যটি হল –
‘He who strideth across the highest mountains laugheth at all tragedies’.
আর এজন্য তাদেরকে আমরা চারিত্রিক গুণে নির্মল হতেই দেখি। যাদের মাঝে কোন প্রকার লাম্পট্য থাকবে না এবং তারা হবেন সত্য ও পবিত্রতার আদর্শ প্রতীক। এ আদর্শ অস্তিত্বের পূর্ণ আদর্শ। এ আদর্শ অসাধারণ বিচক্ষণ ও কৌশলী। যে সবকিছু করতে পারবে ভয়-ডরহীন ভাবে। একেবারে সে হবে ‘ন ডরাই’ এর পূর্ণ প্রতিফলন। যে পূরণ করবে ঈশ্বরের স্থান। আর তাই তার রাজ্যে ঈশ্বরের কোন জায়গা কোথাও থাকবে না। কারণ সে নিজেই হবে ঈশ্বর। তাই তার অন্য কোন ঈশ্বরের দরকার পড়বে না। নীটশের ভাষায় – ‘হে লোক সকল সবাই মনোযোগ সহকারে শুন, সকল ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে তাই আমরা এখন চাই অতিমানব বেঁচে থাক। আমি শিক্ষা দিচ্ছি অতিমানবের কথা। মানুষ এমন যে, তাকে অতিক্রম করে যেতেই হবে’।
এবার আসা যাক এই অতিমানব কে হবেন সেই প্রশ্নে।
এর আলোচনায় নীটশে মানুষ জাতির লিঙ্গ পরিচয় কে সামনে নিয়ে আসেন এবং বলেন ‘এই অতিমানব হবে অবশ্যই একজন পুরুষ’ মানুষ। আর তার এই কথায় ফুটে ওঠে তিনি নারী সম্পর্কে কীরূপ ধারণা প্রকাশ করেছেন। সেজন্য তার মতামত অনেক বেশি সমালোচিত হলেও তাঁর অতি মানবীয় যে আলোচনা তা আজ অবধি সারাবিশ্বে প্রশংসার দাবি রাখে ও এখন পর্যন্ত মানুষকে উদ্দীপ্ত করে রাখছে। যা একটি দেশের সমাজকে পরিবর্তন করে দিতে পারে খুব সহজেই।
লেখক: সাদিকুর রহমান, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
নিউজ গার্ডিয়ান/ এমএ/