জাহিদুল হকঃ
উত্তাল হাওরের ঢেউ আর আফালের সাথে সংগ্রাম করেই সুনামগঞ্জের মানুষের জীবন। পানি তাদের নিত্য সঙ্গী, ফসলের সময় বন্ধু, বর্ষায় দেয় নানাপ্রকার মৎস। বলা হয় মৎস পাথর ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ। জলজোৎস্নার শহরের প্রায় প্রতি টা মানুষ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দক্ষ। কারন তাদের সাথে বন্যার সম্পর্ক নিবিড়। সেই বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা বর্ষা থাকে নানা প্রস্তুতি। কেউ কেউ বাশ দিয়ে আড় (বেড়া) দেয় আবার সোনালী ফসলের জন্য কেউ কেউ ধানের ভাড়াল করে শক্ত। মূলত যারা স্বচ্ছল তারাই পারে এটা করতে আবার ভূমিহীন কৃষক চাটাইয়ের বড় বস্তা দিয়ে রাখে অর্জিত ধান। ফসল উঠলে শুরু হয় উৎসব ছেলে মেয়ের বিয়ে,নতুন ঘর তোলা।
স্থানীয় প্রবাদ আছে- যে বছর ফসল ভাল, সে বছর বিয়ে হয় বেশি।
প্রায় প্রতিবছর ঘরের ক্ষতি হয় এটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়ছে।
ছোটবড় কয়েকশো হাওর সুনামগঞ্জে ৩৫ লক্ষ মানুষ সবাই পরোক্ষভাবে হাওরের উপর নির্ভরশীল।হাওর কেন্দ্রিক তাদের জীবন।
সম্ভবত ২০০৪,০৫,০৬ সালে ব্যাপক বন্যায় ফসল তলিয়ে দিয়েছিল। তখন মিডিয়া কভারেজ ছিল না। মহাজনের চড়া সুদে টাকা নিয়ে জীবন চলতো। এখন এটা কমেছে। ২০১৭ সালের আগাম বন্যায় তলিয়ে দেয় ফসল। মানুষ হাহাকার চরমে তখন ভালভাবে মিডিয়াতে আসে। যার ফলে বের বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক দূর্নীতি। সংস্কার করা হয় বাঁধে সিস্টেম তবুও দূর্নীতি দূর হয়নি । কারন শিয়ালের কাছে মুরগী বাকির মত দায়িত্ব দেয়া হয়।
এবারের বন্যা পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে নজিরবিহীন দূর্দশা নেমেছে। ঘরবাড়ি,ধান হারিয়ে কোন রকম জীবন বাচিয়েছে। পুরো বন্যায় মারা গিয়েছে সরকারি হিসেবে ২৩ জন যদিও আসল সংখ্যা বেশি।
মফস্বল এলাকা বিদুৎ নাই,সংবাকর্মীরা বিচ্ছিন্ন আসছে না কোন খবর। আমি নিজে পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি ৩ দিন পুর। পানি যখন ঘরে ঢুকে ছোট বোন ফোন দিয়ে জানাল যে দোয়া কইরো ঘরে পানি৷ কতটা উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় গিয়েছে সময় তার আল্লাহ তালা ছাড়া কেউ জানে না। পরিচিত ফোন দিচ্ছে কল দিয়ে পরিবার পাচ্ছে না। কি ভয়াবহ অবস্থা। আবার ডাকাতের উৎপাত মানুষকে করেছে ভয়ার্ত।
সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি বুঝতে হলে জীবনে একবার হলেও যেতে হবে সুনামগঞ্জ।
এবার আসি দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যা ছিল অত্যন্ত নাজুক। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হচ্ছে তবুও নৌকা রাখেনি প্রশাসন। আমার উপজেলা পোস্ট দিয়ে নৌকা খুজতে হয়েছে নির্বাহী অফিসারের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল কোন হটলাইনের প্রচারণা৷ মানুষ হাহাকার করছিল কোথায় যাবে। তিনপর আসলো বিদুৎ মানুষ নামলো কাজে যেভাবে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় তরুনরা ফান্ড সংগ্রহ করতে লাগল। দেশে বিদেশ থেকে মানুষ টাকা পাঠানো শুরু করল। তখন স্বস্তি এসেছে কিছুটা মানুষের মনে।
এই বন্যার্তদের জন্য প্রয়োজন এখন ত্রাণ। পরে দরকার কর্মসংস্থানের। বই খাতা ভাসিয়ে নেয়ায় বেড়েছে ঝরে পড়ার ভয়। সবমিলিয়ে একটি যৌক্তিক পরিকল্পনা দরকার।
চোখে ছলছল করা আর ক্ষুধার্ত পেটে খাবারের অপেক্ষা যা মর্মান্তিক৷ পরিচিত অনেকেই জানিয়েছেন যে ঘর বাড়ি নিশ্চহ্ন কোথায় উঠবেন জানা নাই। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই দূর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব না। তাই সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। মানবিক ভূমিকা রাখতে এই সময়ে।
তরুনরা যেভাবে কাজ করছে সেটা মনে করিয়ে দেয় এইদেশ তারুণ্যের। সবশ্রেনীর মানুষ যাচ্ছেন দূর্গতের কাছে।নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, ঔষুধ আর তাদের ভালবাসা। আমার উপজেলা টিম গঠন করে কাজ করছে একদল তরুন। হাওরের ঢেউ পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষের কাছে সেবা দিতে।
এসব কিছুই সেচ্ছাসেবীরা করছে। শুধু ভলান্টিয়ারদের উপর নির্ভর না করে,
পাশাপাশি সুষ্ঠু দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য দাবি জানাতে হবে। সরকারকে আরো বেশি আন্তরিক ও হাওরাঞ্চলের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে।
সর্বোপরি আসুন মানুষের পাশে দাড়াই, ভালবাসা দিয়ে মমতা দিয়ে অর্থ দিয়ে।
লেখকঃ জাহিদুল হক, সাবেক শিক্ষার্থী- সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাবি।