আমরা যাকে সুখী জীবন বলে সম্বোধন করি, সবকিছুই যার ছিল। কমতি ছিল না পারিবারিক সম্পত্তির বা জীবনকে উপভোগ- আরাম- আয়েশে কাটিয়ে দেয়ার মত উপাদানের। কিন্তু বণিক পিতার সম্ভ্রান্ত পথকে ধারণ না করে; যিনি দুঃখ দুর্দশাময় আর কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে জীবন পরিচালনা করতেন, আজকের দিনে সেই বিখ্যাত বেনেডিট স্পিনোজারই মৃত্যু দিবস। মাত্র অল্প বয়সে যিনি নিজ ইহুদি ধর্মের প্রায় সব কিছু জেনে বুঝে ধর্ম গুরুর খেতাব পেয়ে যাচ্ছিলেন, সেই তাকেই নাকি একসময় তাঁর স্বজাতি ধর্ম অপব্যবহারের জন্য ঘর ছাড়া করলো। ভাবা যায় যার পূর্বপুরুষ ধর্মাপরাধে আজকের পর্তুগাল থেকে এসে আশ্রয় নিলেন নেদারল্যান্ডে তাকেও তাঁর এই ভূমি প্রায় ত্যাগ করতে হলো! ছোটবেলা থেকে নিজ গোত্রের কাছে আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত তিনি যখন নিজ গুরু ভ্যান ড্যান এন্ডের থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করার পথে আগালেন তখনই তাঁর পথে ছন্দপতন ঘটতে থাকে। প্রথমে নিজ গুরুকে সরকারি আদেশে ফাঁসি এবং পরে গুরুকান্নার পানি গ্রহণ করতে গিয়ে তার থেকেও বঞ্চিত হয়ে বেছে নিলেন নির্জনতা,একাকীত্ব এবং আধ্যাত্মিকতাকে। দিনের বেলায় চশমার কাজ পরিষ্কার করা আর রাতের বেলায় একান্ত মনে অধ্যবসায়ের ফলে একে একে তিনি রচনা করতে থাকেন তাঁর মস্তিষ্কে বয়ে যাওয়া স্ফুলিংগুলোর। প্রথমে ১৬৬৩ সালে এবং পরের সাত বছর পর ছদ্মনামে ’A Treaties on Religion and the State’ বের হওয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই ফাঁস হয়ে যায় লেখকের নাম। ফলে আবারো পড়লেন বিপদে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী শাণিত ক্ষুরধার আর উর্বর মস্তিষ্ক সম্পন্ন যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা মহাপুরুষদের রুখতে পেরেছে এমন সাধ্য কার ছিল? যখন স্বজাতি তাকে জিজ্ঞেস করল যে তুমি কি সত্যিই এরকম কথা বলেছ যে – ‘ফেরেশতাদের ধারণা ভ্রান্ত কল্পনা মাত্র, আত্মা কেবল জীবনী শক্তির নামান্তর, ওল্ড টেস্টামেন্টে অমরতা সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ নেই?’
গোত্রের লোকজন আসলে চাচ্ছিলেন তিনি না বলুক। ফলে এই আলোকবর্তিকা তাদের সাথেই থেকে যাবে। নিজ গোত্রকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু না তিনি তাদের কান পড়া শুনলেন না বরং বললেন হ্যাঁ আমি বলেছি তো। আর এখানেই প্রতীয়মান হয় তাঁর পোক্ত নৈতিকতার।
যার সম্পর্কে স্বয়ং রাসেলও বলেন “Ethically he is supreme” এখানে রাসেল সতর্কতার সাথে is শব্দ ব্যবহার করে সকল যুগের নীতির ধারকদের চেয়ে তাকে সুপ্রিম বলার পক্ষেই আপাত রায় দিয়ে গেলেন। আর সেই মহান নীতিবিদের Ethics গ্রন্থটি যখন ১৬৭৪ সালে রচনার কাজ শেষ করেন তখনও তিনি বইটি প্রকাশ করার মতো পরিবেশ অনুকূলে পাননি; বরং চারদিকে ছড়িয়ে যায় যে নাস্তিক স্পিনোজা আরও একটি ধর্মবিরোধী ঈশ্বরকে হেয় করে এমন অপকর্ম করেছে। তখন স্পিনোজারই এক সময়ের শিষ্য পত্রে লিখে- “আপনি মনে করেন শেষমেশ আপনি সত্যিকার দর্শনের খোঁজ পেয়েছেন। বহুকাল ধরে যে সকল দর্শন চর্চিত হয়েছে, হচ্ছে এবং পরবর্তীতেও চর্চা করা হবে সেসব দার্শনিক তত্ত্ব থেকে আপনার দার্শনিক ভাবনা যে শ্রেষ্ঠ তা আপনি কীভাবে জানলেন?”
শিষ্য আলবার্ট বার্গকে তিনি ঠান্ডা মাথায় যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আজও আমাদের জন্য এক মহান শিক্ষা এবং তিনি তার চিঠির উত্তরে বলেছিলেন “অবশেষে তুমি যে সর্বোত্তম ধর্ম শিক্ষকদের খুঁজে পেয়েছ এবং তাদের উপর তোমার সকল বিশ্বাসকে ন্যস্ত করেছো- কী করে জানলে যারা ধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন, এখন দিচ্ছেন বা ভবিষ্যতে দিবেন তাদের কথা সর্বোত্তম?
নিজ প্রেমিক, শিষ্য, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত আজকের দিনে তাঁরই দেশে পূজনীয় এই মহান ব্যক্তিটি কিভাবে দর্শনে অবদান রেখেছিলেন তাঁর আলোচনা ৪৪ বছর বয়সে যক্ষ্মায় মৃত্যুবরণকারী মহান দার্শনিক স্পিনোজার মৃত্যু দিবসে নিশ্চয় আমাদের জানার দাবি রাখে।
১৯২১ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী আলবার্ট আইনস্টাইনকে যখন একসময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি নাস্তিক কিনা কিংবা ঈশ্বর সম্পর্কিত তাঁর অভিমত কি? তখন তিনি কিনা একসময়ের নাস্তিক খেতাবপ্রাপ্ত স্পিনোজাকে সামনে এনে বলে বসেন আমি স্পিনোজার ঈশ্বরের অনুসারী! তাহলে তার ঈশ্বর কেমন ছিল?
ঈশ্বরের আলোচনায় তিনি Pantheism মতবাদের জন্ম দিয়ে যে নতুন একমাত্রা যোগ করেন তাঁর সেই আলোচনায় তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে বলেন ঈশ্বরের কোন গুণ নেই। কারণ গুণারোপ করা হলে তার নির্গুণও আছে বলে ধরতে হবে এবং কার্যত তাকে সীমিত করা হয়। যার কোন অস্তিত্বকে তিনি তাঁর বিখ্যাত এথিক্স গ্রন্থে স্বীকারও করেননি। তিনি তাঁর জ্ঞানীয় গুরু দেকার্তের আলোচনাকে উপসংহারে পৌঁছে দিয়ে বলেই ফেলেন যে “একমাত্র ঈশ্বরকেই দ্রব্য বলা যায় আর তাই তাঁর দর্শনে দ্রব্য ও ঈশ্বর আলাদা বলে কোন কিছু নয় বরং এক ও অভিন্নই।
আর এই দ্রব্যের আলোচনায় তিনি বলেন দ্রব্য শাশ্বত এক ও অদ্বিতীয়, যা অসীম ও চূড়ান্তভাবে স্বাধীন এবং যার কোন গুণ নেই ও তার থেকে সবকিছুই নিঃসৃত এবং সর্বোপরি এই দ্রব্যই হল ঈশ্বর।
মহান এই জ্ঞান সাধক বইয়ের প্রতি তাঁর যে অপরিসীম ভালোবাসা তা প্রকাশ করেছিলেন এই একটি লাইনের মাধ্যমে। যেখানে তিনি আমাদেরকে বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করে বলেন “ভালো খাদ্যবস্তুতে পেট ভরে কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে”
তাঁর আজকের এই প্রয়াণ দিবসে জানাই হাজারো প্রণাম শান্তি আর ভালোবাসা এবং স্পিনোজার বিদ্রোহী আত্মা আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী কিংবা গোলাম মর্তুজার আত্মাকেও ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ুক একুশ শতকের সকল তারুণ্যে।
লেখক: সাদিকুর রহমান, শিক্ষার্থী- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
Sadikur.stu20161@juniv.edu